জানুয়ারি ৬, ২০২১
১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ

এক বছরে ৪ শতাধিক প্রবাসী সিলেটি শ্রমিকের মৃত্যু

খবর ডেক্সঃ- ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকাসহ বিভিন্ন মহাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন অসংখ্য সিলেটি। শ্রমিক ভিসায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী আছেন মধ্যপ্রাচ্যে। তাদের অনেকেই প্রবাসে মারা যান পরিবারের আড়ালে। কেউবা মারা যান দুর্ঘটনায়, কারো মৃত্যু হয় রোগে, আর কারো হয় স্বাভাবিক মৃত্যু। গত বছরেই মারা গেছেন সিলেটের ৪১২ প্রবাসী শ্রমিক। কিন্তু এই মৃতদের পরিবারের কেউ কেউ পেলেও অনেকেরই সরকারি সহায়তা সময়মতো না পাওয়ার হতাশা আছে। আবার যারা পেয়েছেন তাদের অন্তহীন ভোগান্তিরও অভিযোগ রয়েছে।

মৃতদের মধ্যে বৈধ শ্রমিকের সংখ্যাটা সরকারি হিসাবে আসে, তাদের পরিবার সরকার থেকে একটা অনুদান পেয়ে থাকে। তবে অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যাটা সব সময় থেকে যায় অগোচরে। গেল বছরে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে সিলেটের অনেক তরুণ মারা গেছেন। তাদের প্রকৃত সংখ্যা বাংলাদেশ জনশক্তি ব্যুরো অফিসের কাছে নেই। এছাড়া তাদের মৃতদেহ দেশে আনতে মৃতের পরিবারকে সকল খরচ বহন করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারী সহযোগিতা নেই।

জনশক্তি ব্যুরো অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রবাসে মৃত বৈধ শ্রমিকদের মধ্য থেকে গত ১ বছরে সিলেট বিভাগে মারা গেছেন ৪১২ জন। জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী শ্রমিকদের মরদেহ দেশে আসলেও করোনাকালে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় মৃতদের মরদেহ দাফন হয়েছে সে সব দেশেই। তবে প্রবাসে দাফন হলেও বৈধ শ্রমিকের পরিবার সরকারের পক্ষ থেকে ৩ লক্ষ টাকা করে আর্থিক অনুদান পেয়েছে। প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী শ্রমিকদের মধ্য সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রবাসী মারা যান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদী আরবে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ওয়েজ আনার্স বোর্ডের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, গেল বছরে প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী ৯০৯ জন বৈধ শ্রমিকের পরিবারকে অনুদান বাবদ ৩ লক্ষ টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। সিলেট বিভাগেও ৪১২ জন প্রবাসীর পরিবার এই টাকা পেয়েছেন। করোনা মহামারী চলাকালে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় মৃত শ্রমিকদের মরদেহ দেশে না আসলেও তাদের পরিবারকে এই অনুদান প্রদান করা হয়েছে। তবে অনেকেরই মাঝে অনুদান না পাওয়ার হতাশা আছে।

জনশক্তি ব্যুরো অফিস সিলেটের জরিপ কর্মকর্তা কাজল সরকার জানান, বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা থেকে ২০২০ এর জানুয়ারী মাসে ৩৭, ফেব্রুয়ারী মাসে ৩৪, মার্চ মাসে ১৩, জুন মাসে ১৬, জুলাই মাসে ১৯, আগষ্ট মাসে ৪২, সেপ্টেম্বর মাসে ২৩, অক্টোবর মাসে ৪১, নভেম্বর মাসে ২৮, ডিসেম্বর মাসে ৪৫ জন মৃত প্রবাসীদের পরিবার অনুদান লাভ করেছেন। এর মধ্যে লকডাউন ও ফ্লাইট বন্ধ থাকায় এপ্রিল-মে মাসে কোন আবেদন জমা হয়নি। সিলেটের ৩টি জেলায় মোট ২৯৮ জন আবেদনকারীর মধ্যে যেসব শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে তাদের পরিবার দাফন বাবদ ৩০ হাজার টাকা এবং সরকারী অনুদান বাবদ ৩ লক্ষ টাকা করে পেয়েছে। করোনাকালে আবেদনকারীদের কারো মরদেহ দেশে না আসায় তাদের পরিবার শুধু ৩ লক্ষ টাকা করে অনুদান পেয়েছে।

কাজল সরকার জানান, আগে মৃত প্রবাসীদের পরিবারকে দেয়া অনুদানের চেক সিলেট অফিস থেকে দেয়া হলেও এখন সবকিছু অনলাইনে হয় এবং টাকাটা আবেদনকারীর একাউন্টে জমা হয়ে থাকে। তাই সময় মত তথ্য পেতে আমাদের বিলম্ব হয়।
জনশক্তি ব্যুরো অফিস মৌলভীবাজারের জরিপ কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান আকন্দ জানান, গেল বছরে মৌলভীবাজার জেলায় প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী ১১৪ জন শ্রমিকের পরিবার আর্থিক অনুদানের তদন্ত প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। কয়েকটি ছাড়া প্রায় সবকটি পরিবারই আর্থিক অনুদান পেয়েছে।

তিনি জানান, মৌলভীবাজার জেলায় জানুয়ারী মাসে ৫, ফেব্রুয়ারী মাসে ১১, মার্চ মাসে ৭, জুন মাসে ২, জুলাই মাসে ২, আগষ্ট মাসে ১৬, সেপ্টেম্বর মাসে ২০, অক্টোবর মাসে ১৯, নভেম্বর মাসেম ১৭ ও ডিসেম্বর মাসে ১৫ জন মৃত প্রবাসীর পরিবার আবেদন করেন। কয়েকটা আবেদন ব্যাতিত প্রায় সব পরিবারই আর্থিক অনুদান পেয়ে গেছেন।

জনশক্তি ব্যুরো অফিস সূত্রে জানা যায়, ইউরোপের দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ছাড়া বিশে^র সকল দেশে অবস্থানরত বৈধ শ্রমিকদের ডাটাবেজ জনশক্তি ব্যুরো অফিসের কাছে থাকে। গেল বছরে প্রবাসে কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে সৌদী আরব, আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, মালয়েশিয়া, জর্দান, লেবানন, ইরাক, লিবিয়া সহ অন্যান্য দেশের প্রবাসীরা রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেসব শ্রমিক বিএমইটি (বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) এর তালিকাভুক্ত রয়েছে তাদের পরিবারও বাংলাদেশ ওয়েজ আর্নার্স বোর্ডের অনুদান পেয়ে থাকেন।

সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার লালুখালী গ্রামের আব্দুল মালিকের ছেলে জালাল আহমদ ৮ বছর আগে ওমানের দেশ মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান। গেল বছরের মে মাসে করোনা মহামারী চলাকালে ওমানে মারা যান ৫ ছেলে ও ১ মেয়ের জনক জালাল আহমদ। করোনাকালে ফ্লাইট বন্ধ থাকায় তার মরদেহ দেশে আনা সম্ভব হয়নি। বৈধ শ্রমিক হিসেবে ওমানে থাকায় বাংলাদেশ ওয়েজ আর্নার্স বোর্ড থেকে তার পরিবার ৩ লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছে। গেল বছর সৌদী আরবে মারা যান সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার তেলিখালের বশিরুদ্দীন কামালী। তার স্ত্রীও পেয়েছেন ৩ লক্ষ টাকা। আরব আমিরাতে মারা যান হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার নারায়নদি গ্রামের প্রদীপ রঞ্জন কর। তার স্ত্রীও পেয়েছেন ৩ লক্ষ টাকা। সৌদী আরবে মৃত্যুবরণকারী হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা গ্রামের দীপু মিয়া চৌধুরীর পরিবারও পেয়েছেন ৩লক্ষ টাকা। এভাবে গেল বছরে করোনাকালে মৃত্যুবরণকারী শ্রমিকদের মরদেহ দেশে না আসলেও অনেক পরিবার ৩ লক্ষ টাকা করে অনুদান পেয়েছে।

এ ব্যাপারে জনশক্তি ব্যুরো সিলেটের সহকারী পরিচালক মীর কামরুল হোসেন বলেন, মৌলভীবাজার জেলা ব্যাতিত বিভাগের ৩টি জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে আমরা কাজ করছি। কোন বৈধ প্রবাসী শ্রমিক মারা গেলে তাদের লাশ দেশে আসলে দাফন বাবদ ৩০ হাজার টাকার চেক আমাদের অফিস থেকে দেয়া হয়। এছাড়া আর্থিক অনুদান বাবদ ৩ লক্ষ টাকার প্রসেসিং আমাদের অফিস করে থাকলেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে মৃতের অভিভাবকের একাউন্টে টাকা দেয়া হয়ে থাকে। বৈধভাবে প্রবাসে গেলে মৃত্যুর পরও প্রবাসীদের পরিবারের পাশে সরকারের সহযোগিতা থাকে। অবৈধভাবে প্রবাসে গেলে নিজের জীবন যেমন হুমকীর মূখে পড়ে তেমনী পরিবারও হয়ে পড়ে অসহায়।

শেয়ার করুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *