সিলেটের প্রান্তিক জনপদ হিসেবে পরিচিত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারী বন্ধ থাকায় পাথর সংশ্লিষ্ট জীবিকা নির্বাহকারী হাজারো শ্রমিক ব্যবসায়ি রোজগার বঞ্চিত হয়ে পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
সিলেট মানেই পাথরের রাজ্য, এক সময়ের এ পরিচয়টুকু এখন হারিয়ে গেছে। খরস্রোতা ধলাই নদীর বিস্তীর্ণ উজানে অবস্থিত অফুরন্ত পাথরের ভান্ডার থেকে পাথর আহরন করে নৌকা এবং ট্রলি দিয়ে তা পরিবহন করে যে মানুষগুলো যুগ যুগ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল, আজ তারা তীব্র খাদ্য সংকটে নিপতিত।
কাজ নেই, রোজগার নেই এ অবস্থায় বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত ভোলাগঞ্জ কেন্দ্রীক পঞ্চাশ সহস্রাধিক মানুষের জীবন আজ চরম দুর্বিষহ। বিকল্প কোন রোজগার না থাকায় ও উপুর্যুপরি বন্যা এবং অতিবৃষ্টির কারণে ফসল বিনষ্ট হওয়ায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় শোনা যাচ্ছে দুর্ভিক্ষের পদ ধ্বনি।
পাথর আহরনেই সমৃদ্ধ জনপদঃ
স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের আবকাটামোগত উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক পাথর সিলেটের পাথর কোয়ারীগুলোই যোগান দিয়ে আসছিলো। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদীর উজানে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম পাথর কোয়ারীতে পাথর আহরন করে এ অঞ্চলের মানুষগুলো পরিজন নিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দেই জীবিকা নির্বাহ করতো। শ্রমিক কর্তৃক আহরিত এ পাথর বিপনন এবং প্রক্রিয়া করণে এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় হাজারো স্টোন ক্রাশার। এসব স্টোন ক্রাশারে আরও লক্ষাধিক শ্রমজীবি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়ে এক সময়ের অবহেলিত অঞ্চল ক্রমশঃ সমৃদ্ধ জনপদে রুপান্তরিত হয়। স্থানীয়ভাবে পাহরিত পাথরের গুনগত মান ভালো হওয়ায় প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়। পাথরের আর্শীবাদে সিলেটের এ প্রান্তিক জনপদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিপুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বৃহৎ কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান না থাকায় একমাত্র পাথরকে কেন্দ্র করেই সৃষ্ট জীবিকা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্র সিলেটের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
ধ্বংসের সূচনা যে ভাবেঃ
যুগ যুগ ধরে লাখো শ্রমিক বেলচা কোদাল দিয়ে বালি সরিয়ে পরিবেশের ক্ষতি না করে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর আহরন করলেও কয়েক বছর পূর্বে শ্রমিকদের এ স্বাভাবিক রোজগারের উপর দৃষ্কৃত কারিদের নজর পড়ে। শ্রমজীবি মানুষকে বঞ্চিত করে এ চক্র পাথর কোয়ারী এলাকায় নামিয়ে দেয় ড্রেজার বা বোমা মেশিন। পরিবেশ বিধ্বংসী এ ড্রেজার মিশিন ব্যবহার করে এরা পাথর আহরনের নামে কোয়ারী এলাকার পরিবেশ এবং প্রতিবেশ বিনষ্টের উৎসবে মেতে উঠে। এ বোমা মিশিনের বিরুদ্ধে শ্রমজীবি লোকগুলো প্রথম দিকে প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণ করলেও দৃষ্কৃতকারীদের শক্তির কাছে এরা অসহায় হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং অপ্রতিরোধ্য শক্তির কাছে অসহায় শ্রমজীবি মানুষগুলো এক পর্যায়ে নতি শিকারে বাধ্য হয়। বোমা মিশিনের ধ্বংসযজ্ঞকে পাশ কাটিয়ে তবুও শ্রমজীবি লোকগুলো পাথর কোয়ারীর একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে পাথর আহরনে নিয়োজিত থেকে তাদের জীবিকার চাকা সচল রাখে। এক পর্যায়ে বোমা তথা ড্রেজার মিশিনের ধ্বংসযজ্ঞ চরম আকার ধারন করলে সক্রিয় হয়ে উঠে প্রশাসন।
পাথর খোঁকোদের অপতৎপরতাঃ
হাজারো লাখো শ্রমজীবি মানুষের স্থায়ী রোজগারের এ বিশাল ক্ষেত্রে এক সময় সক্রিয় হয়ে উঠে প্রভাবশালী পাথর খেঁকোচক্র। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারী ছাড়াও এ চক্রের শ্যান দৃষ্টি নিপতিত হয় নয়নাভিরাম শাহ্ আরপিন পাথুরে টিলাভূমিতে। ঐতিহ্যবাহী এ টিলার কথিত খাদেম সেজে জনৈক সুলতান আহমদ সর্ব প্রথম ২০০২ সালে এ টিলা ধ্বংসের সূচনা করে। পরবর্তীতে সুলতান আহমদকে হটিয়ে স্থানীয় চিহ্নিত একাধিক পাথর খেঁকো চক্র শাহ্ আরপিন টিলা ধ্বংস করে হাজার হাজার কোটি টাকার পাথর আত্মসাত সহ এ অঞ্চলের পরিবেশ এবং প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধনে লিপ্ত হয়। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আনুকূল্য থাকায় শাহ আরপিন কেন্দ্রীক পাথর খেঁকো চক্র এক সময় দানবীয় আকার ধারন করে। এভাবে শ্রমজীবি মানুষের রোজগারের ক্ষতি সাধন করে পাথর খেঁকো চক্র হয়ে উঠে কোয়ারী এলাকার মুর্তিমান আতংঙ্ক।
প্রশাসনিক পদক্ষেপ এবং ………. !
বোমা (ড্রেজার) মিশিনের ধ্বংসযজ্ঞ, টিলা ভূমির ক্ষতিসাধন, পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি ইত্যাদি অপকর্ম চরম আকার ধারণ করলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। স্থানীয় ও জাতীয় গমাধ্যমে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশিত প্রচারিত হলে সাড়া পড়ে যায় সর্বত্র। নড়ে চড়ে উঠে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। গঠন করা হয় টাস্কফোর্স। ধারাবাহিক অভিযান পরিচালিত হয় পাথর কোয়ারী এলাকায়। অনমনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপের কারনে নির্মূল হয় বোমা মিশিন, তথা পাথর খেঁকোচক্র। শ্রমজীবি মানুষগুলোও তাই চেয়েছিল। বংশ পরস্পরায় তারা যে পেশায় নিয়োজিত থেকে জীবিকার নির্বাহ করছিলো তাদের জীবিকার প্রধান অন্তরায় পাথর খেঁকো চক্র উৎখাত হওয়ায় তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছিল।
এ যেনো আাগছা ছাঁটতে বৃক্ষ নিধনঃ
বোমা মিশিন এবং পরিবেশ প্রতিবেশ বিধ্বংসীদের দমন করতে যেয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোয়ারী এলাকায় সকল প্রকার পাথর আহরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। একসময় পাথর কোয়ারী থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতো যা সরকারি কোষাঘারে জমা হয়ে দেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতো। তা ছাড়া শতশত কোটি টাকার পাথর নিজস্ব ক্ষেত্র থেকে আহরিত হওয়ায় সাশ্রয় হতো মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা। বিগত দুই বছর ধরে কোয়ারী লীজ না হওয়া এবং পাথর আহরনে প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞার কারনে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয়ের পাশাপাশি খেটে খাওয়া শ্রমজীবি মানুষগুলোকে পড়তে হয়েছে আকুল পাথারে। এ অবস্থাকে আগাছা ছাঁটতে বৃক্ষনিধন বলে মন্তব্য করেছেন পাথর শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম।
পরিবেশ ধ্বংসকারি নিপাত যাক শ্রমিকেরা অধিকার ফিরে পাকঃ
খরস্রোতা নদী দিয়ে ঢলে নেমে আসা পাথর শ্রমিক কর্তৃক বেলচা-কোদাল দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে আহরন করলে পরিবেশ বা প্রতিবেশের কোন প্রকার ক্ষতি সাধিত হয়না। বর্ষার তীব্র পাহাড়ী ঢলে উজান থেকে বিস্তীর্ণ ভূমিতে নেমে আসে বিপুল পরিমান পাথর। শুস্ক মৌশুমে এ পাথর আহরনে নিয়োজিত থাকে হাজারো শ্রমিক। আহরনকৃত পাথরের শূণ্যস্থান পুনরায় বর্ষায় পরিপূর্ণ হয় পাথরে। এ ধারাবাহিকতা চলে আসছে যুগযুগ ধরে। শ্রমিকরাও স্বাচ্ছন্ধে তাদের রোজগার চালিয়ে আসছিলো। কিন্তু পাথর কোয়ারী এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক বোম মিশিন তথা পরিবেশ ধ্বংস কারিদের দমন করতে যেয়ে স্বাভাবিক পাথর আহরন বন্ধ করে দেয়ায় শ্রমজীবি মানুষগুলো চোঁখে শর্ষে ফুল দেখছে। তাইতো সম্প্রতি তারা পরিবেশ ধ্বংসকারী মুক্ত নিরাপদ পাথর কোয়ারীতে স্বাভাবিক নিয়মে পাথর আহরনের দাবীতে সোচ্ছার হয়েছে। পাথর সংশ্লিষ্ঠ শ্রমিক ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে তারা সংশ্লিষ্ট এলাকায় মানববন্ধন, সমাবেশ এবং সংবাদ সম্মেলন সহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। তাদের স্লোগান হলো “পরিবেশ ধ্বংসকারি নিপাত যাক, শ্রমিকেরা অধিকার ফিরে পাক” “পাথর খেঁকো আর পাথর শ্রমিক এক নয়” ইত্যাদি।
খুলে দেয়া হোক শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্রঃ
ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারী বন্ধ থাকায় পাথর আহরন থেকে বঞ্চিত দিন মজুর অভাবী মানুষগুলো চরম দুর্দশায় নিপতিত হয়েছে। এদের পাশাপাশি পাথর বিপননের জড়িত হাজারো ব্যবসায়ি- শ্রমিক রোজগার ও কর্মহীন হয়ে গভীর সংকটের ঘেরাটোপে পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়ে দেনা শোধ করতে না পেরে ঋণ খেলাপীর কারণে মামলায় জেবরার হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এছাড়া পাথর পরিবহনে নিয়োজিত পরিবহন শ্রমিক ও মালিকেরা তাদের ক্রয় করা ট্রাক ও ট্রাকটরের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে এক কঠিন অবস্থার মুখো মুখি এসে দাড়িয়েছেন। এ গভীর সংকট থেকে উত্তরনের জন্য পাথর কোয়ারী হতে পরিবেশ সম্মত সনাতন পদ্ধতিতে পাথর আহরনের দাবী জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত লোকগুলো। সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পাথর সংশ্লিষ্ট জীবিকা সচলের জোরালো দাবী উত্থাপন করা হয়।
পরিবেশ রক্ষা এবং মানুষের জীবিকা দুটোই জরুরীঃ
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পাথর ব্যবসায়ি সমিতির সভাপতি আব্দুল জলিল বলেন, পাথর খেঁকো পরিবেশ বিধ্বংসীরা দুর্বৃত্ত, এদের দমন করে কঠোর প্রশাসনিক মনিটরিং ব্যবস্থার অধীনে পাথর কোয়ারী খোলে দেয়া হোক। তার এ দাবীর সাথে একাত্মতা পোষন করেন ব্যবসায়িনেতা শওকত আলী, জসিমুল ইসলাম, রেনু মিয়া, পাথর শ্রমিক রিয়াজ উদ্দিন, আব্দুল কবির, আব্দুস সাত্তার, মাসুক মিয়া, সোহেল মিয়া সহ আরও অনেকে। তাদের মতে শ্রমজীবি পাথুরে শ্রমিকদের দ্বারা কখনোই পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হয় না। তারা বেলচা-কোদাল দিয়ে অতিসাধারণ ভাবে পাথর আহরন করে। পরিবেশের শত্রু হলো বোমা মেশিন তথা পাথর খেঁকোরা। তাদের দাবী অনতিবিলম্বে পাথর কোয়ারী খোলে না দিলে সংকটে নিপতিত লাখো মানুষের জীবনে চরম মানবেতর অবস্থা নেমে আসবে।
সর্বশেষঃ
সিলেটের প্রান্তিক জনপদ কোম্পানীগঞ্জের সিংহভাগ মানুষের জীবন-জীবিকা পাথর আহরনের উপর নির্ভরশীল। লাখো শ্রমজীবি ব্যবসায়ির এ রাজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাওযায় গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছেন লোকগুলো। কর্মহীন হয়ে পড়া বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীর বিকল্প রোজগার না থাকা এবং বন্যায় ফসলের ক্ষতি সাধন হওয়ায় নিকট ভবিষ্যতে এ জনপদের চরম খাদ্য সংকটের আশংকা করছেন অনেকে। তাইতো এ অঞ্চলের আপামর মানুষের দাবী-পরিবেশের নির্মলতা বজায় রেখে নিরাপদে পাথর আহরনের সুযোগ দিয়ে রক্ষা করা হোক লাখো মানুষের জীবন। শ্রমজীবি মানুষগুলো তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীকে এগিয়ে আসার দাবী জানিয়েছেন।
লেখক- শাব্বির আহমদ
সভাপতি, কোম্পানীগঞ্জ প্রেসক্লাব।