জুলাই ২৯, ২০২০
৯:১১ পূর্বাহ্ণ

‘চীন-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি ও আঞ্চলিক অস্তিরতা’- জাহিদ আজাদ।

জাহিদ

জাহিদ আজাদ:- সীমান্ত একটি দেশের ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণী স্থানকে বুঝায়।বিশ্বের প্রতিটি দেশেরই এক বা একাধিক প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে,রয়েছে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে পরস্পর বিরোধী নানা মতভেদ এবং বিরোধ।তেমনি এশিয়ার অন্যতম পরমাণু শক্তিধর দুই দেশ চীন ও ভারতের মধ্যেও রয়েছে দীর্ঘ দিনের সীমানা বিরোধ।এশিয়ার আরেক পরমাণু শক্তিধর দেশ পাকিস্তান যার সাথেও ভারতের রয়েছে দীর্ঘ কালের সীমানা বিরোধ।বছর ব্যাপী বিশ্বের যে সকল সীমান্ত নিয়ে চলে টান-টান উত্তেজনা সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত,ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্ত,উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়া সীমান্ত,পাক-ভারত সীমান্ত,চীন-ভারত সীমান্ত,পাক-আফগান সীমান্ত এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত।

চীন ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত বিরোধ বেশ পুরনো।সীমানা বিরোধকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ শিংজ্যাং-এ(আকসাই চীন ও অরুনাচল প্রদেশ) ১০ থেকে ২১ অক্টোবর ১৯৬২ সালে সংগঠিত হয় প্রথম চীন-ভারত যুদ্ধ।সে যুদ্ধে ভারত  চীনের কাছে আকসাই চীনের কর্তৃত্ব হারায়।ফের ১৯৬৭ সালে দু’দফায় সিকিম রাজ্যের নাথু লা এবং চো লা নামক দুইটি স্থানে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়।ঐ যুদ্ধে চীন ভারতের কাছে পরাজিত হয়ে চো লা থেকে সরে যায়।দীর্ঘ ৫০বছর পর ২০১৭ সালের ১৬ জুন ডোকলামে চীনা সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে চীন-ভারতের মধ্যে ফের উত্তেজনা শুরু হয়।সে সময় ভারত ভুটানের পক্ষে অবস্থান করে।কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের কারনে চীন ও ভুটান উভয়ই এই অঞ্চলটি নিজেদের বলে দাবি করে আসছে।মূলত এই ডোকলামকে কেন্দ্র করেই চীন ও ভুটানের মধ্যে বিরোধ চলছে।

১৯৬৭ সালের দ্বিতীয় চীন-ভারত যুদ্ধের পর চলদি বছর ৫ মে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা(এলএসি) নিকট লাদাখে চীনা ও ভারতীয় সেনারা মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।মে মাসের শেষ দিকে ২১ তারিখে চীনা বাহিনী গালওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে ভারতীয় সড়ক নির্মাণে আপত্তি জানিয়েছিল।ফলে উত্তেজনা নিরসনে কুটনৈতিক পর্যায়ে চলে আলোচনা।পরবর্তীতে ১৫ জুন ২০২০ তারিখে গালওয়ান উপত্যকার একটি পার্বত্য অঞ্চলের খাড়া অংশে অনেকটা অন্ধকার পরিবেশে সীমান্ত অতিক্রম করা নিয়ে পরস্পর বিরোধী অভিযোগের ভিত্তিতে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পাথর,লাঠি,লোহার রড ও পেরেকযুক্ত মুগুর নিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা অবধি চীনা ও ভারতীয় সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।সেই সংঘর্ষে একজন কর্ণেলসহ ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন।তাদের মধ্যে তিন জন ঘটনাসস্থলেই নিহত হন। বেশ কয়েকজন ভারতীয় সৈন্যকে আটক করা হলেও পরবর্তীতে চীনা সেনা বাহিনী তাদের ফেরত দেয়।

গোটা ভারত জুড়ে শুরু হয় চীনা বিরোধী বিক্ষোভ।বিক্ষোভে ফুসে উঠে জনতা,দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে।কুটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাবার পাশাপাশি ভারত সরকার ২৯ জুন চীনের টিকটকসহ ৫৯টি অ্যাপস ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।অপরদিকে সীমান্তে সেনা সদস্যসহ ভারী সমরাস্ত্র বাড়ানোর সাথে সাথে চলতে থাকে উভয় দেশের যুদ্ধ বিমানের নিয়মিত মহড়া।চীন ও ভারত পরস্পর পরস্পরকে সীমান্তে অস্থিরতা ছড়ানোর জন্য অভিযোগ করতে থাকে।এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চিরায়ত নিয়মানুযায়ী চির শত্রু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দেশ চীনের প্রভাব রুখতে ভারতকে সর্বাত্মক সহায়তা করার ঘোষণা দেয়।বাড়তে থাকে টান টান উত্তেজনা।

উল্লেখ্য যে, চীন-ভারত সীমান্তে মোট ২০টি বিরোধপূর্ণ এলাকা রয়েছে। চীন-ভারত সীমান্ত সর্ম্পকে যখন তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে তখন গত বছর বিতর্কিত সীমান্ত এলাকা কালাপানি, নিম্পুয়াধারা এবং নিপুলেখ কে নিজেদের বলে দাবি করে ভারতের প্রকাশিত নতুন রাজনৈতিক মানচিত্রের প্রতিবাদে নেপালের মন্ত্রিসভা ঐ এলাকাগুলোকে নিজেদের দাবি করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করার নীতিগত অনুমোদন দেয়।অন্যদিকে গত ৮ই মার্চ ভারতীয় রাজ্য উত্তরাখণ্ডের পিথাউরাগড়-লিপুলেখের মধ্যে একটি লিংক রোডের উদ্ভোধন করেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।ফলে নেপাল-ভারত সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।থেমে নেই ভারতের আরেক প্রতিবেশী দেশ ভুটান।ভারতের আসামের বাকলা জেলার কৃষকেরা সেচের পানির জন্য ভুটান থেকে আসা অভিন্ন নদীর পানির উপর নির্ভরশীল।ভুটান সরকার এসকল নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে।ফলে আসামের কৃষকরা সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

তাই বলা যায়,ভুটানের সাথেও ভারতের বর্তমান সম্পর্কটা তেমন ভালো যাচ্ছে না।নদীর পানি নিয়ে নেপালের সাথেও ভারতের ঝামেলা চলছে।নেপাল-ভারতের সীমান্তবর্তী নদী গন্ডকে যে ব্যারেজ দেওয়া হয়েছিল তাতে গেইট আছে মোট ছত্রিশটা যার অর্ধেক ভারতের দিকে আর বাকি অর্ধেক নেপালের দিকে।সম্প্রতি নেপালের দিকের আঠারো তম গেইটে নেপাল কর্তৃপক্ষ হঠাৎ প্রাচীর তুলে দিয়েছে যার ফলে বিহারে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।ভারতের আরেক প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানও থেমে নেই।কাশ্মীর ইস্যুতে পাক-ভারত সম্পর্ক মোটেও ভাল নেই।একদিকে মোদী সরকারকে ১৩০ কোটি নাগরিকের করোনাভাইরোসের সংক্রমণ থেকে বাঁচানোর কথা ভাবতে হচ্ছে অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সীমান্তে উত্তেজনার চাপ নিয়েও মাথা ঘামাতে হচ্ছে।সব মিলিয়ে চীন-ভারতে সীমান্ত উত্তেজনা এখন এক আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করেছে।একমাত্র প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সাথেই কেবল ভারতের তথা কথিত বন্ধু সুলভ সুসম্পর্ক আছে বলে দেশ দুটি দাবি করলেও কাগজে-কলমে বেশ গড়মিল রয়েছে।গরু ও মাদকদ্রব্য পাচারের অভিযোগে বছরের পর বছর সীমান্তে অবৈধ হত্যা,অভিন্ন নদীর পানির অসম বণ্টন এবং বানিজ্য ঘাটতিসহ রয়েছে নানাবিধ সমস্যা।নেপাল এবং ভুটান আগে ভারতমুখী হলেও এখন এ দুটি দেশ যে মোটেও ভারতমুখী নয় তা একেবারেই স্পষ্ট।দেশ দুটি এখন চীনমুখী।বাংলাদেশও অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় স্বার্থের দিকে খেয়াল করে কোন দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে তা সময়ই বলে দেবে।

অন্যদিকে গত ২২জুলাই ২০২০ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডে্ন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এনে টেক্সাস রাজ্যের হিউস্টনে অবস্থিত চীনের কনস্যুলেটকে শুক্রবারের মধ্যে বন্ধ করে দেবার ঘোষণা দেন।এর প্রতিবাদে চীনা সরকার পরের দিনই চেংদুতে অবস্থিত মার্কিন কনস্যুলেট বন্ধের ঘোষণা দিয়েছি।আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন,দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার জন্যই ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।চীন-মার্কিন সম্পর্কের অবস্থা যখন এমন উত্তেজনাকর তখন রাশিয়া চীনের পাশে থাকার অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছে।
এক কথায় বলতে গেলে এমন ভাবে বলা যায় যে,চীন-ভারত সীমান্ত সমস্যা এখন আর দুটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।এটি আঞ্চলিক সমস্যায় রুপ নিয়েছে।

লেখক:- ছড়াকার, কবি ও কলামিস্ট।
তারিখ:- ২৯-০৭-২০২০খ্রি.।

শেয়ার করুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *