খবর ডেক্সঃ- অবশেষে রায়হান হত্যা মামলার প্রধান আসামী সিলেট বন্দর বাজার পুলিশ ফাড়ির বহিস্কৃত এসআই আকবর গ্রেফতার হলো। তবে তার পলায়ন যেভাবে ছিল প্রশ্নবিদ্ধ অনুরূপ তার গ্রেফতার বা তাকে আটক করা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে বাংলা ও হিন্দি ভাষাভাষী গ্রাম্য লোকেরা আকবরকে গরু ছাগল বাঁধার দড়ি দিয়ে তার কোমরে, দুই হাতে ও পায়ে বাঁধতেছে এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আর আকবর তাদের কাছে বার বার প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। এসময় আকবর আর্তনাদ করে বলছে ‘আমাকে বলা হয়েছে, দুই মাসের জন্য চলে যাও, পরে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেলে চলে আসবা।’
আকবরের আটক হওয়ার পর গ্রাম্য সাধারণ লোকজনের জিজ্ঞাসাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কাছে যেসব তথ্য দিয়েছে এসবের পরিপ্রেক্ষিতে একটু নড়েচড়ে বসেছেন সিলেটের পুলিশ প্রশাসন। আন্দোলনরত সিলেটবাসী দাবি জানাচ্ছেন যে, আকবরকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগদানকারী এবং যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আশ্রয় প্রশ্রয়ে আকবর বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়েছে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্য দিকে সিলেটের পুলিশ সুপারের প্রেস ব্রিফ্রিং এ দেওয়া বক্তব্য নিয়েও চলছে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা। তিনি বলেছেন, আকবরকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আর ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে আকবরকে সাধারণ জনগণ আটক করছে। তবে বিষয়টি পরবর্তীতে খোলাসা হয়েছে যে, জেলা পুলিশের বিশ্বস্ত বন্ধুদের সহায়তায়ই আকবরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মূলত আমরা যে সমাজে বসবাস করছি এখানে অন্ধকার একটি জগত রয়েছে। বহু লোক আছে যারা দিনের আলোতে ভাল মানুষের পরিচয় দিয়ে বেড়ায় কিন্তু রাতের আধারে ওরা হয়ে উঠে সেই অন্ধকার জগতের নায়ক খলনায়ক। আপনার আশে পাশে কিংবা দূরে হয়ত এমন বহু চেনামুখ রয়েছে যাদের বিচরণ রয়েছে সেই অন্ধকার জগতে। যেখানে বলি দেয়া হয় মানবতা, পদপিষ্ট হয় মানবিকতা। যেখানে সামান্য প্রতিহিংসার কারণে কিংবা টাকা পয়সার লোভে কোন তরুণ তাজা প্রাণকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে নরপশুরা উল্লাস করে। পরের দিন হয়ত তাকে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয় অথবা চোর ডাকাত কিংবা ছিনতাইকারী বলে কবরে চালান দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যেভাবে চালান দেয়া হয়েছিল সিলেটের টগবগে যুবক রায়হানকে। রায়হান হত্যার ঘটনা থেকে এরকম একটি ধারণা পাওয়া যায়।
রায়হানের ভাগ্য ভাল। সে মরেনি! কেবল জীবন দিয়েছে। তবে নিজের জীবন দিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সমাজের সেই অন্ধকার জগতটাকে। যদিও তার সন্তান এতিম হয়েছে, তার মা হারিয়েছেন বুকের ধন, স্ত্রী হয়েছেন বিধবা, বোন হারিয়েছেন আদরের ভাইকে। কিন্তু তার লাশ থেকে জন্ম হয়েছে এক শক্তিশালী রায়হানের, যে প্রতিবাদ ও লড়াইয়ের দাবানল জ্বালিয়ে দিয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। সে রুখে দাঁড়িয়েছে আরো শত সহস্র রায়হান হয়ে। অন্ধকার জগতের নায়ক খলনায়কদের মুখোশ খুলে দেয়ার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে বলছে- রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ, রুখে দাঁড়াও নতুন প্রজন্ম, যুগ যুগ ধরে চলে আসা নীপিড়ন ও নির্মমতার লৌহকপাটে আঘাত হান, ভেঙ্গে ফেল জুলুমের কালো হাত, গুড়িয়ে দাও মানুষের মুখোশ লাগানো অমানুষগুলোর সকল আস্তানা।
হিংস্র শিয়াল কুকুর ও হায়নাদের মত রায়হানের উপর হামলে পড়েছিল মানুষরূপী সেই অমানুষগুলো। একবারও তাদের বুক কাঁপেনি একটি যুবকের প্রাণ কেড়ে নিয়ে একটি নিস্পাপ শিশুকে এতিম করতে, এক অবলা বোনকে বিধবা বানাতে, এক দুখিনী মায়ের বুক খালি করতে। এই নারকীয়তা ও পৈশাচিকতার তান্ডব চালিয়েছে তারা পুলিশের পোষাক পরে। এই দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য, তাদের ঘামঝরা টেক্সের টাকা দিয়ে কেনা বন্দুক দিয়ে তাদের বুকে, হাতে, পায়ে ও পিঠে গুলি করে ঝাঝরা করা হয়। এমন দুর্ভাগা জাতি আমরা, যেখানে গুম, খুন আর নারী ধর্ষণ একেবারে ডাল-ভাতের মত।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে যে, সিলেটের বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে অহরহ মানুষকে হয়রানী ও নির্যাতন করা হত এবং ঘুষ গ্রহণ করা হত। জানিনা কত নিরপরাধ মানুষকে এখানে এনে রায়হানের মত পৈশাচিক নিয়মে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। যেখানে দশ হাজার টাকার জন্য রায়হান খুন হতে পারে সেখানে আরো কত কিছু ঘটতে পারে তা তো সহজেই বুঝা যায়। আর এসব অপকর্মের সাথে হয়ত আরো অনেকই জড়িত আছে। কারণ পুলিশ ফাড়িতে এসব অপকর্ম চলে আর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানবেন না এটা বিশ্বাস যোগ্য না। তাছাড়া সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে হয়ত এ ঘটনায় শুধু পুলিশের সম্পৃক্ততা নয় বরং বের হয়ে আসতে পারে আরো অনেক কিছু।
কেউ ছিনতাইয়ের সংবাদ দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ রায়হানকে গ্রেফতার করে। কিন্তু ছিনতাইয়ের অভিযোগে রায়হানকে গ্রেফতার করে রাতভর অমানবিকভাবে নির্যাতন করে হত্যা করার দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, ঘটনার পেছনে অন্য কিছু রয়েছে। কারণ রায়হান কেবল ছিনতাইকারী হলে তাকে এভাবে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হতো না। অর্থাৎ, এখানে অন্য কোন কারণ রয়েছে। আর কারণ কী হতে পারে এটা এক রকম স্পষ্ট যে, হয়ত সংশ্লিষ্ট পুলিশরা রায়হানের কোন প্রতিপক্ষ কিংবা রায়হানের কারণে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে এমন কোন পক্ষের কাছ থেকে বড় অংকের কোন বিনিময় নিয়ে রায়হানকে হত্যা করেছে। আর না হয় কোন দুষ্কৃতিকারী পক্ষের সাথে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা সরাসরি সম্পৃক্ত। দুটি সম্ভাবনাই সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর।
সমাজে নানা রকম অপরাধকর্ম যেমন- হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতী দিন দিন বেড়েই চলেছে। অপরাধীরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে, অপরাধের ধরণ পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু অপরাধ বন্ধ হচ্ছেনা। এসবের পেছনে পুলিশের দুর্বলতা এবং তাদের অপকর্ম বহুলাংশে দায়ী। পুলিশের অনেক অপরাধের কথা বিভিন্নভাবে প্রকাশ হচ্ছে। এখন “পুলিশ” শব্দের সাথে একটা অপরাধমূলক মনোভাব সংযোজিত হয়েগেছে। একটা ঘটনা সংঘটিত হলে নানা রকম কিচ্ছা কাহিনী তৈরী করে মূল অপরাধীদের আড়াল করে ঘটনার সাথে অন্যদের জড়ানোর চেষ্টা করে পুলিশ। এরকম অভিযোগ ও কাহিনী প্রায়ই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বলতে গেলে এই একটি বিভাগের দুর্নীতির কারণে আজ গোটা সমাজে নানা রকম অপরাধ অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে। এই বিভাগটিকে কি দুর্নীতি মুক্ত করে সংস্কার করা যায় না? কী কারণে পুলিশে অপরাধ প্রবণতার জন্ম হয় এ বিষয়টি নির্ণয় করা দরকার। দেশবাসীর পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকেছে, তারা চায় কলুষমুক্ত পুলিশ বাহিনী। সিলেটবাসী রায়হান হত্যার সুষ্ঠু বিচার চায়
নভেম্বর ১৬, ২০২০
৫:৪৩ অপরাহ্ণ