খবর ডেস্ক
মার্চ ৭, ২০২৩
৯:৩৬ অপরাহ্ণ
শবে বরাত আসলে কী?

শবে বরাত আসলে কী?

শবে বরাত নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোনো বিভেদ-বিবাদ নেই। আছে এই দিনকে কেন্দ্র করে যে সকল বিদয়াত আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়েছে সে সকল বিদয়াত নিয়ে। যারা শবে বরাতকে সরাসরি অস্বীকার করেন বা শবে বরাতের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন এটা কোনোভাবেই মানবার মতো নয়। শবে বরাত সরাসরি কুরআন দিয়ে সেভাবে প্রমাণিত না হলেও অনেক হাদিস দ্বারা তার অস্তিত্বের প্রমাণ মিলে, এর ফজিলতের প্রমাণ মিলে। এরমাঝে সহিহ হাদিসের সাথে রয়েছে বেশ কিছু জয়ীফ বা দুর্বল হাদিস। তবে জয়ীফ হাদিস সমূহ একাধিক সনদে বর্ণিত হলে তা হাসান হাদিস রূপে পরিগণিত হয়। কাজেই যেহেতু এখানে শবে বরাতের ফজিলতের বিষয় তাই হাসান হাদিস থেকে তা নেওয়া যায়।

সমস্যা তাহলে কোথায়: শবে বরাত কে সরাসরি যারা অস্বীকার করেন তারা না জেনেই করেন। তবে যারা শবে বরাত পালনে আড়ম্বরতা নিয়ে বা অত্যাধিক উৎসাহ নিয়ে কথা বলেন তাদের কথায় অবশ্যই যুক্তি আছে এবং এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে আমাদের সমাজে যারা শবে বরাত নিয়ে উৎসাহ একটু বেশি প্রকাশ করেন তারা কখনও কখনও সেই উৎসাহে সীমা ছাড়িয়ে যান। আর সমস্যাটা মূলত শুরু সেখানেই। বেশিভাগ সময়ই সেই অতি উৎসাহ বিদায়াতের দিকে ধাবিত হয়। আর এটা যারা করেন তারা মূলত কুরআন সুন্নাহের দিকে না তাকিয়ে সমাজে চলে আসা রীতি বা গতির দিকে তাকিয়ে করে থাকেন। কিন্তু এটা চিরন্তন এবং শাশ্বত যে কুরআন সুন্নাহ মৌলিকভাবে সামাজিক রীতি বা গতির ধার ধারে না। যদি তাই হতো, তবে মুহাম্মদ সা. যে সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন তা কখনোই হতো না। সামজিক রীতি মেনে চললে কাফের সমাজও তার বিরুদ্ধে যেতো না।

শবে বরাত নিয়ে তাহলে কি হয়?
আমরা দেখি শবে বরাতের মর্যাদা বা মহিমা নিয়ে যারা কথা বলেন তারা শবে বরাতের মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে এতবেশি কথা বলেন যে বেশিরভাগ সময় তা মর্যাদার দিক দিয়ে লাইলাতুল ক্বদরকে ছাড়িয়ে যায়। অথচ লাইলাতুল ক্বদরের মর্যাদা, এ রাতে আমলের গুরুত্ব এতবেশি যে লাইলাতুল ক্বদরের ধারেকাছও আর কোনো রাত আসতে পারবে না। লাইলাতুল ক্বদর এত গুরুত্বপূর্ণ যে এই রাত নিয়ে হাদিস তো আছেই, সরাসরি কুরআনের একটি সূরাই নাজিল হয়েছে ক্বদর নামে। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায় লাইলাতুল ক্বদর ঠিক সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয় না যতোটা না লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান বা শবে বরাত পালন করা হয়। কাজেই আমাদের এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এখানে শবে বরাত নিয়ে কোনো সমস্যা নেই বরং সমস্যা হলো শবে বরাত পালন নিয়ে। আরো স্পষ্ট করে বললে শবে বরাতে পালন করা এমন কিছু কাজ নিয়ে যা উৎসাহের দিক দিয়ে বিদায়াতের কাছে চলে যায়। তাই বলে শবে বরাত নেই, শবে বরাত পালন করা বিদায়াত এটা বলা যাবে না। শবে বরাত পালনে কোনো সমস্যা নেই সমস্যা হলো শবে বরাতে মানুষের আচরণ বা আমল নিয়ে।

শবে বরাতের ফযিলত অনেকগুলি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু শবে বরাত নিয়ে যে বিদয়াত প্রচলিত তাতো অস্বীকার করতেই হবে। যেমন কিছু লোক দেখা যায় এশার সালাত আদায় করে না, আবার ফজরের সালাতও আদায় করে না। তবে রাত জেগে নফল ইবাদত করে, মাজারে যায়। আবার কিছু মহিলা পাওয়া যায় রুটি ও হালুয়া তৈরি করতে করতে সালাত আদায় করতে ভুলে যাযন, কিন্তু তারা আবার রাত জেগে শুধু নফল সালাত আদায় করে। এটা তো পরিতাপের বিষয়।

শবে বরাত কি?
শবে বরাত বা লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান বা মধ্য শাবানের রজনী হচ্ছে হিজরি শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত, যা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে শব-ই-বরাত নামে পালিত একটি পূণ্যময় রাত। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মুসলমানগণ বিভিন্ন কারণে এটি পালন করেন। এই রাতকে লাইলাতুল বরাত বলাও হয়। মধ্য শাবানের এ রজনী নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। এ রাতের ফজিলতের মহাগুরুত্ব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে। কুরআন-সুন্নাহর সঠিক জ্ঞানই এই পথ থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে। আর এতে মুসলিম উম্মাহর বিভাজনের রেখা অনেকাংশেই মিটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সহিহ হাদিস দ্বারা জানা যায়, রাসুল সা. প্রতি চন্দ্র মাসে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতেন। উল্লেখ্য যে, সঠিক কোনো প্রমাণ না থাকলেও ইবাদতের শুরুতে মুসলিম সমাজে বিদয়াত চালু হয়েছে ব্যক্তি বিশেষের দোহাই দিয়ে। উদাহরণ স্বরূপ কাউকে যদি বলা হয়, কেন তুমি এভাবে জিকর বা ইবাদত করছ? সে সঙ্গে সঙ্গে বলবে, অমুক অলি, অমুক পিরসাহেব, অমুক আলিম করেছেন তাই করি। সে এ কথা বলে না যে, আল্লাহ বলেছেন তাই করি, রাসুল সা. বলেছেন, করেছেন বা সম্মতি দিয়েছেন তাই করি বা অমুক সাহাবা করেছেন তাই করি। সত্যিই এটি মহাপরিতাপের বিষয়। এটা কাম্য নয়।

শবে বরাতের অস্তিত্ব প্রমাণে বিভিন্ন সহিহ হাদিস বিদ্যমান। কতিপয় জয়ীফ হাদিসও রয়েছে। একাধিক সনদে জয়ীফ হাদিস সমূহ বর্ণিত হওয়ায় তা হাসান হাদিস রূপে পরিগণিত। মনে রাখতে হবে বির্তকিত ও দুর্বল (জয়ীফ) হাদিসের সংখ্যা বেশি হলেও কিছু সংখ্যক সহিহ হাদিসও রয়েছে বিধায় এ রাতের অস্তিত্ব অস্বীকার করার কোনো সুয়োগ নেই। হাদিসে এসেছে, হজরত আয়িশা রা. হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, একরাতে আমি রাসূল সা. এর সাথে ছিলাম। এক সময় উনাকে বিছানায় না পেয়ে আমি মনে করলাম যে, তিনি হয়ত অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। অতঃপর আমি খোঁজ করে তাকে জান্নাতুল বাক্বীতে পেলাম। সেখানে তিনি প্রার্থনা করছেন। এ অবস্থা দেখে ফিরে এলে তিনিও ফিরে এলেন এবং বললেন, আপনি কি মনে করেন আল্লাহর রাসূল সা. আপনার সাথে আমানতের খিয়ানত করেছেন? আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ সা. আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি হয়তো আপনার অন্য কোনো আহলিয়ার হুজরা শরীফে তাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর রাসূল সা. বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রিতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন অর্থাৎ রহমতে খাস নাজিল করেন। অতঃপর তিনি বণী কালবের মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে থাকেন। (সুনানে তিরমিজি (২/১২১,১২২), (মুসনাদে আহমাদ ৬/২৩৮) ইবনে মাযাহ, রযীন, মিশকাত শরীফ,ফাওজুল ক্বাদীর, ২য় খন্ড, পৃ,৩১৭)।

আরেকটি হাদীসে এসেছে, আবু বাকর রা. বর্ণনা করেন আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রাতে (দুনিয়ার আসমানে) আসেন এবং সকলকে মাফ করে দেন কেবল সেই ব্যক্তি ছাড়া যার হৃদয়ে ঘৃণা বিদ্বেষ রয়েছে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরিক করে (অর্থাৎ মুশরিক)। (আল-আলবানী বলেন, “হাদিসটি অন্য সূত্রে সহীহ।” তাখরীজ মিশকাত আল মাসাবীহ, (ক্রম, ১২৫১) (ইবন হাজর আল-আসক্বালানী তাঁর আল-আমাল আল-মুথলাক্বাহ গ্রন্থ (ক্রম, ১২২)।

শবে বরাতের আমল: এ রাতের আমল নিয়ে মনীষিরা মনে করেন, এ রাতের আমাল সমূহ ব্যক্তিগত, সম্মিলিত নয়। ফরজ নামাজ তো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়াই উত্তম। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো প্রমাণ হাদিসে নেই আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর কোনো প্রচলন ছিল না। (ইকতিযাউস্ সিরাতিল মুস্তাকীমঃ ২/৬৩১-৬৪১; মারাকিল ফালাহ ২১৯)। তাই শবে বরাত নিয়ে আমাদের উচিত মনগড়া বা ব্যক্তি মতাদর্শে আবেগী না হয়ে ইসলামি রীতি অনুযায়ী চিন্তা করা, কথা বলা, আমল করা। এতে আমল সুন্দর হবে আবার ঐক্যেও ঝামেলা হবে না।
লেখক: মুনশী ইকবাল :সাংবাদিক, চিকিৎসক

শেয়ার করুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *