ডিসেম্বর ৩, ২০২০
৭:৫০ পূর্বাহ্ণ

সিলেট নগরীতে রাতের আঁধারে দানব ট্রাক

খবর ডেক্সঃ- সিলেটে বেপরোয়া ট্রাকের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলে উঠেছে। রাতের শহরে ট্রাক যেন হয়ে উঠে একটি ঘাতক যান। বেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কায় প্রায় সময়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও। বেপরোয়া এসব ট্রাকের কারণে চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন নগরবাসী ও পথচারীরা।

রাতের ফাঁকা সড়কে ইচ্ছামতো দ্রæত গতিতে ট্রাক-লরি গাড়ি চালাচ্ছে একশ্রেণির চালক। মধ্যরাতে পুলিশের চেকপোস্ট এড়িয়ে একটু ফাঁকা পেলেই যেন ঝড়ের গতি পায়। স্পীডব্রেকারের কোনো তোয়াক্কা না করেই ট্রাকগুলো তীব্র গতিতে ছুটে চলে। এ ভয়ংকর অবস্থা চলে সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত। বেপরোয়া ট্রাক ও লরির চাপায় প্রাণ যাচ্ছে পথচারী ও মোটরসাইকেল আরোহীর। গত এক বছরে নগরীতে নারীসহ অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাতের নগরে রীতিমতো আতঙ্ক আর জীবনবাজি রেখে রাস্তায় চলাচল করতে হয় পথচারী ও যাত্রীদের।দ্রুতগতির ট্রাক চালকদের কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে ছোট ছোট যানবাহন বা রাতের পথচারীদের জীবন। সেসময় দেখা মেলে না কোনো ট্রাফিক পুলিশকেও।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মহাসড়কের মতোই রাতের বেলা নগরীর রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ী চলে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাক, লরি, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ একই গতিতে ঢুকে পড়ে রাস্তায়। মধ্যরাতের পর বেপরোয়া গতিতে চলে কিছু কিছু প্রাইভেট কারও। বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা দল বেঁধে রাতে গাড়ি নিয়ে গতির প্রতিযোগিতায় নামে। কেউ কেউ গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণও নেয়। এ কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু রাতের রাজপথের শৃঙ্খলায় নেওয়া হচ্ছে না কোনো কার্যকর পদক্ষেপ।

এদিকে, রাত সাড়ে ১০টার পরই নগরীর রাজপথে থাকে না ট্রাফিক পুলিশ। গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিগন্যালে রাত ২টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও সেগুলোতে দেখা যায়না পুলিশ সদস্যদের। ফলে রাত বাড়ার সাথে সাথে চরম ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়।

সোবহানীঘাট পয়েন্টের এক চা বিক্রেতা বলেন, আমরা দোকান সারা রাত খোলা থাকে। এই মোড়ে রাতে ট্রাফিক পুলিশ থাকে না। ট্রাক ও লরিগুলো কোনটি উত্তর আবার কোনটি দক্ষিণ দিক থেকে দৈত্যের মতো আসে। প্রায়ই অন্য গাড়িতে লাগিয়ে দেয়। গাড়িগুলো জোরে আইয়া (এসে) হঠাৎ ঘোরে। কোনটি বন্দরবাজারের দিকে আবার কোনটি সোজা কুমারপাড়ার দিকে যায়। মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে। কুমারপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, কাজের কারণে আমি বেশি রাত করে বাসায় ফিরি। সোবহানীঘাট এলাকার রাস্তা দিয়ে যেতে বুক কাঁপে। প্রায়ই ভো ভো শব্দ করে রেসিং কারের মতো জোরে গাড়ি চালায় একটা দল। ওরা কিচ্ছু মানে না।

ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগ ও সিটি এসবি পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে সিলেট নগরীতে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক সড়ক দূর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ঘটনা রাত ১০টার পর থেকে ভোর ৬টার মধ্যে। আর গাড়িগুলো গতি ছিলো ৮০ কিলোমিটারেরও বেশি। এসব দূর্ঘটনায় শুধুমাত্র বেপরোয়া ট্রাক ও লরি’র ধাক্কায় নিহত হয়েছেন ১০ জন। এদের মধ্যে শিক্ষার্থী, গৃহবধূ ও রিকশা চালক রয়েছেন। সর্বশেষ গত সোমবার ভোরে নগরীর আম্বরখানায় ট্রাকের চাপায় এক যুবক নিহত হন। আহত অনেকেই হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।

রাতের সিলেট নগরীতে গেলো এক বছরের বেপরোয়া ট্রাকের চাপায় নিহতের দুর্ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিলো। ১৫ জানুয়ারী রাত সাড়ে ৮টার দিকে সুবিদবাজারে দ্রুতগামী একটি ট্রাকের ধাক্কায় তানিয়া বেগম (২৫) নামে এক গৃহবধূ নিহত হন। তিনি নগরীর চৌকিদেখির ৪৩/১ নুরজাহান ভিলার আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী। ২১ জানুয়ারী রাত ১১টায় নগরীর চৌহাট্টায় ট্রাকের ধাক্কায় ইমতিয়াজ মাহবুব মির্জা (২০) নামে এক কলেজ ছাত্র নিহত হন।

গত ২১ ফেব্রুয়ারী সকালে নগরীর সুরমা মার্কেট পয়েন্টে বেপরোয়া গতির ট্রাকের চাপায় রফিকুল ইসলাম (৩৫) নামের এক রিকশাচালক নিহত হন। তিনি রংপুর জেলার তারাগঞ্জ থানার একরশালি ইউনিয়নের মাটিয়াল পাড়ার মৃত লুৎফুর রহমানের ছেলে। ২২ মার্চ আম্বরখানা পয়েন্টে একটি ট্রাক কেড়ে নেয় দেবাশীষ দে পিনাকের জীবন।

৭ আগস্ট বিকেশ সাড়ে ৩টার দিকে চৌহাট্টায় ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহীর রাফি আহমদ (১৮) নামের এক তরুন নিহত হন। তিনি হাওয়াপাড়ার আলাউদ্দিনের আহমদের ছেলে। ৩০ আগস্ট রাত ১১টার দিকে নগরের নাইওরপুল পয়েন্টে ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান মোহন আহমদ (২৫) নামে এক তরুণ।

এর আগে নগরীর আম্বরখানায় পাথরবাহী ট্রাকের চাপায় ঘটনাস্থলেই সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক শাহ আলম (২১) ও খায়রুল ইসলাম (২৪) নামে দুইজন নিহত হন। সর্বশেষ ২৩ নভেম্বর রাত ৩টার দিকে আম্বরখানায় ট্রাক চাপায় ইমরান ডালি (২০) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। তিনি ইমরান সদর উপজেলার রঙ্গিটিলার লাল মিয়ার ছেলে।

সার্বিক বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) ফয়সল মাহমুদ জালালাবাদকে বলেন, রাতে গাড়ি কম থাকে, আর আমাদেরও লোকবল কম। রাতে অধিকাংশ সিগন্যাল পয়েন্টে পুলিশ সদস্যরা থাকেন। তাই ২টা পর্যন্ত সবখানে লোক দেওয়া যায় না। গতিরোধ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা দ্রুত গতির যে কোন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি এবং নিচ্ছি। এসব গাড়ি আটক করে মামলাও দেয়া হয়। মহানগর ট্রাফিক পুলিশ সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন পয়েন্টে ক্যাম্পেইন করেছে। ফলে চালক ও পথচারীরা সচেতন হয়েছেন। এজন্য আগের চেয়ে অনেকটা সড়ক দুর্ঘটনা কমে এসেছে।

শেয়ার করুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *