খবর ডেক্সঃ- সিলেটে মোবাইল ব্যবহারের সাথে পাল্লা দিয়ে মোবাইল চুরি ও হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। কেবল ৯ মাসে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ছয় থানায় মোবাইল খোয়ানোর চার শতাধিক জিডি হয়েছে। কিন্তু চুরি হওয়া বা হারিয়ে যাওয়া এসব মোবাইল উদ্ধারের হার শূন্যের কোটায়। কারণ মোবাইল উদ্ধারে পুলিশের ততপরতা কিংবা আগ্রহ খুবই কম বলে অভিযোগ অনেকের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সিলেটে মোবাইল চুরির একটি বড় সিন্ডিকেট কাজ করছে। ব্যস্ত নগরের ভিড়ে এই চোর সিন্ডিকেট মানুষের শখের মোবাইলটি কৌশলে কেড়ে নিচ্ছে। তাতে কেউ জিডি করছেন, কেউ নিরবে চলে যাচ্ছেন। তবে জিডি করেও মোবাইল উদ্ধারে ব্যর্থ হচ্ছেন প্রায় সকলেই।
হারানো সংক্রান্ত যে কোনও মামলা বা জিডি ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে আমলযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য। তবে হারানো সংক্রান্ত জিডি অনুসন্ধান অথবা তদন্তে বেশিরভাগ পুলিশ কর্মকর্তাদের অনিহা রয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। ফলে এ সংক্রান্ত জিডি থানায় শুধু নথিভুক্ত হিসেবেই থেকে যায়।
ছিনতাইয়ের শিকার, চুরি অথবা অচেতন মনে অনেকেরই শখের ফোনটি হারিয়ে যায়। মোবাইল ফোন চুরি হলে বা হারিয়ে গেলে অনেকেই তা ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেন। শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষার জন্যই থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ফোনের মালিকরা। নগরীর থানাগুলোতে প্রতিনিয়ত এ সংক্রান্ত বহু জিডি দায়ের হচ্ছে। তবে এসব জিডি’র ভিত্তিতে হারানো ফোন উদ্ধারের পরিমাণ খুবই কম। ভাগ্যক্রমে কয়েকজনের হারিয়ে যাওয়া ফোন উদ্ধার করা গেলেও অধিকাংশের ফোনই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পুলিশও ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোন উদ্ধারে আগ্রহী নয়। তাই হারিয়ে বা চুরি হয়ে গেলে বেশির ভাগ সময় মোবাইলের আশাই ছেড়ে দেন অনেক মালিক। ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ দেওয়ার মোবাইল ফোন ফিরে পাওয়ার ঘটনা বিরল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনও খবর পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, পুলিশকে তদবির করে মোবাইল ফোনের অবস্থান জানা যায় কখনও কখনও। তবে সিলেটের বাইরে কোথাও মোবাইলের সন্ধান পেলে সেখানে যেতে পুলিশ খরচ চায়। খরচ দিলে মোবাইল এনে দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু মোবাইল ফেরত পাওয়া যায় না বললেই চলে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানান, থানায় মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রসহ মূল্যবান বস্তু হারানো সংক্রান্ত জিডি প্রতিনিয়তই হচ্ছে। নগরীতে চুরি হওয়া, ছিনতাইকৃত অথবা হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন কেনার অনেক সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা এসব চোরাই মোবাইলফোনের আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি) নম্বর পরিবর্তন করে ফেলে। এরপর সেগুলো আবার বিক্রি করে থাকে। এদিকে, দামি ফোন বা ডিভাইস হলে সেগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাঠিয়ে দেয়। এতে করে হারিয়ে যাওয়া অনেক মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। কারণ আইএমইআই নম্বর কার্যকর থাকে না।
হারানো মোবাইল ফোন সংক্রান্ত জিডি’র একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, একটি মোবাইল ফোনের কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) বের করতে হলে কম্পিউটার অপারেটরকে টাকা দিতে হয়। নয়তো তারা কাজ করে না। আবার কোনও কোনও ফোনের একাধিক সিডিআর বের করতে হয়। যতোবার সিডিআর বের করতে হয়, ততবারই তারা টাকা চায়। কিন্তু ভুক্তভোগীর কাছে তো টাকা চাওয়া যায় না। ফলে নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করেই মোবাইলের সিডিআর তুলতে হয়। তাই পুলিশ সদস্যরা মোবাইল ফোন হারানো সংক্রান্ত জিডি তদন্ত করতে আগ্রহ কম দেখান।
খোয় যাওয়া মোবাইলে বিষয়ে অনেকেই কথা বলে এ প্রতিবেদকের সাথে। এরকমই একজন বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী সাঈদ আহমদ। পাশাপাশি একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তিনি। এ বছরের জুলাই মাসে নিজের জমানো ১৪ হাজার টাকা দিয়ে একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন কেনেন। তবে ফোনটি বেশি দিন ব্যবহার করতে পারেননি। গত মাসের শেষ সপ্তাহে জরুরী কাজে বিভাগীয় শহর সিলেটে আসেন তিনি। কাজ শেষে বিকেলে শহরে ঘোরাঘুরির একপর্যায়ে হারিয়ে যায় ফোনটি। অনেক খোঁজাখুজির পরও না পেয়ে কোতোয়ালী মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরী করেন ভুক্তভোগী। মাস পেরিয়ে গেলেও সখের মোবাইল ফোনটি উদ্ধার হয়নি। এ সম্পর্কে জিডি’র তদন্তভার পাওয়া উপ-পরিদর্শক কোন খোঁজও দিতে পারেননি।
সাঈদ বলেন, জিডি করার মাসখানেক পর তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগোযোগ করলে তিনি জানান, আপনার মোবাইল ফোনটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তবুও ফোনের কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) চেক করতে হবে, এতে কিছু খরচ লাগবে। আমি জানাই ফোনটি উদ্ধারের পর সমস্ত খরচ দিয়ে দেবো। এরপর তিনি আর কোনও খোঁজ দেননি।
এ বিষয়ে জিডির তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমি চেক করে দেখেছি, তার মোবাইলফোনটি আর অন হয়নি। যদি অন হয় তবে কল সিডিআর তুলে ট্রেস করা সম্ভব হবে। অপরদিকে কেউ যদি আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে ফেলে, সেক্ষেত্রে ফোন পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
শুধু সাঈদ নয়, তার মতো অনেক ভুক্তভোগী রয়েছেন। দামি মোবাইল ফোন ছিনতাইকারী ও দুর্বৃত্তদের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। পকেট কেটে, ব্যাগ থেকে বা হাত থেকে টান দিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের দারস্থ হন। জিডি করেন থানায়। কিন্তু দিনের পর দিন পার হলেও সেই মোবাইল আর ফিরে পান না মালিকরা। খোয়া যাওয়া মোবাইলটি আর কোনও দিন পাবেন কিনা বা পাওয়ার সুযোগ আছে কিনা, তাও তারা জানতে পারেন না।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের বলেন, কোন মানুষ যখন মোবাইল হারিয়ে জিডি করেন তখন পুলিশের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে সহজ পদ্ধতিতেই মোবাইলটি উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়। প্রাথমিক চেষ্টায় কাজ না হলে বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্ধার কাজ চলে। হারিয়ে যাওয়ার পর কোন মোবাইল সচল থাকলে তা এক সময় না একসময় উদ্ধার হয়। আবার কখনো একাধিক হাত বদলের মাধ্যমে স্থানবদলের কারণে উদ্ধার কাজ অনেক সময় লেগে যায়। বেশির ভাগ সময় সংশ্লিষ্ট মোবাইল সিম কোম্পানি ও মোবাইল কোম্পানিতে আবেদন করেও সিডিআর না পাওয়ার কারণে মোবাইলটির কোন অস্তিত্ব না পাওয়া গেলে সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।